ধূমপানের ক্ষতিকর দিক সমুহ
ধূমপানের কি
সাধারণ যেকোনো দ্রব্যের পোড়ানো ধোঁয়া শ্বাসের সাথে প্রবেশ করলে তাকে ধূমপান বলা গেলেও মূলত তামাকজাতীয় দ্রব্যাদির পোড়া ধোঁয়া গ্রহণকেই ধূমপান হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, বিভিন্ন বৈজ্ঞানিকগণসহ মোটামুটি সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত যে, ধূমপান যক্ষ্মা, ফুসফুসের ক্যান্সার সহ নানা রোগের ঝুঁকি বাড়িয়ে দেয়।
ধূমপানের প্রকারভেদ
সক্রিয় ধূমপান :ধূমপায়ী যে অবস্থায় জলন্ত সিগারেট বা বিড়ি বা চুরুট থেকে উদ্ভূত ধোঁয়াকে ইচ্ছাকৃতভাবে মুখে টেনে সরাসরি ফুসফুসে প্রবেশ করায় তাকে সক্রিয় ধূম্পান বলে।
নিস্ক্রিয় ধূমপান :ধূমপানের সময় ধোঁয়ার যে অংশ চারপাশের পরিবেশে ছড়িয়ে পড়ে এবং অনৈচ্ছিকভাবে মানুষের দেহে নিঃশ্বাসের মাধ্যমে প্রবেশ করে নিস্ক্রিয় ধূমপান বলে।
ধূমপানের ফলে যেসব ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে আপনার-
ধূমপানের কারণে আপনার চোখে কম বয়সেই ছানি পড়তে পারে। নিয়মিত ধূমপান চোখে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস বাড়ায়। ধূমপান ছাড়ার পরও অবশ্য চোখে ছানি পড়ার সম্ভাবনা থেকে যায়।
মাথায় টাক পড়ার সম্ভাবনা
হেয়ার ফলিকলে প্রচ্ছন্ন প্রভাব বিস্তার করে ধূমপান। যার জেরে চুলের গোড়ার ক্ষতি হয়। ধূমপানের প্রভাবে চুল পড়তে শুরু হয়। কারণ ফলিকল কমজোর হয়ে গেলে চুল সহজেই ভেঙে যায়। ধূমপান করা মানুষের টাক পড়ার সম্ভাবনা তাই বেশি।
ধূমপানের জন্য শরীরে ভিটামিন সি-এর অভাব দেখা দিতে পারে। ত্বককে উজ্জ্বল ও সুরক্ষিত রাখার জন্য ভিটামিন সি একটি প্রয়োজনীয় উপাদান। ধূমপান ত্বকে অক্সিজেনের পরিমাণ কমিয়ে দিতে পারে। ফলে ত্বক অনুজ্জ্বল ও ফ্যাকাশে দেখাতে পারে।
রক্ত চলাচলে বাধা
সিগারেট, বিড়ি, হুকো ইত্যাদিতে থাকা তামাক থেকে উৎপন্ন নিকোটিন রক্ত চলাচলে বাধা দেয়। অনেক সময় অতিরিক্ত ধূমপানের ফলে রক্ত জমাট বাঁধতে শুরু করে।
ধূমপানে বয়স বাড়ে
ধূমপানের ফলে চেহারা বুড়িয়ে যেতে পারে তাড়াতাড়ি। অতিরিক্ত ধূমপানের ফলে আপনাকে বয়সের তুলনায় বেশি বয়স্ক দেখা দিতে পারে। কারণ ধূমপান বলিরেখা তৈরির ক্ষেত্রে প্রচ্ছন্ন প্রভাব রাখে।
স্ট্রেচ মার্ক
ধূমপানের কারণে বাড়তে পারে স্ট্রেচ মার্ক। নিকোটিন ত্বকের কানেক্টিভ টিস্যু ও ফাইভারের ক্ষতি করে দেয়। ফলে সাদা স্ট্রেচ মার্ক দেখা দিতে পারে।
ক্ষুধা কমে যেতে পারে
ধূমপানের ফলে ক্ষুধা কমে যেতে পারে। ফলে চেহারায় তার ছাপ পড়তে পারে প্রকটভাবে।
ধুমপান নিয়ে ইসলামে যা বলা হয়েছে
ইসলাম ক্ষতিকর বিষয় থেকে দূরে থাকার আদেশ দিয়েছে। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে,
‘(তোমরা)
নিজের হাতে নিজেকে ধ্বংসের মুখে নিক্ষেপ করো না।’
(সুরা বাকারা,
আয়াত
: ১৯৫)
ধূমপানের বিভিন্ন ক্ষতিকর দিকের প্রতি খেয়াল রেখে ইসলামী আইনজ্ঞরা ধূমপান করাকে মাকরুহ বলে থাকেন।
(ফাতাওয়ায়ে ফকীহুল মিল্লাত
: ১১/৪০৬)।
তা ছাড়া এটি সর্বজনস্বীকৃত বিষয় যে,
ধূমপান কোনো ভালো কাজ নয়। এছাড়া ধুমপায়ীর মুখের দুর্গন্ধে অন্যের কষ্ট হয়,
যা পৃথক একটি গুনাহ। তাই ধুমপান থেকে বিরত থাকা আবশ্যক। কোনো মুমিন ধূমপান করে অন্যকে কষ্ট দিতে পারে না। রাসুল
(সা.)
বলেছেন,
কেউ অপরের ক্ষতি করলে আল্লাহ তার ক্ষতিসাধন করবেন।
(আবু দাউদ,
হাদিস
: ৩৬৩৫)।
আর ধূমপানের কারণে মুখ দুর্গন্ধযুক্ত হলে,
এ অবস্থায় নামাজে দাঁড়ানো মাকরূহে তাহরীমী। বরং এ অবস্থায় মসজিদে প্রবেশ করাও মাকরূহ। হাদীস শরীফে ধূমপানের চেয়ে অনেক কম দুর্গন্ধ বস্ত্ত কাঁচা পেঁয়াজ-রসুন খেয়ে মসজিদে প্রবেশ করতেও নিষেধ করা হয়েছে।
অতএব বিড়ি-সিগারেটের তীব্র দুর্গন্ধের সাথে মসজিদে প্রবেশ করা যে নিষিদ্ধ হবে তা তো সহজেই অনুমেয়। অবশ্য এ কারণে নামাজ ত্যাগ করা যাবে না এবং মসজিদে গমনাগমনও বন্ধ করা যাবে না। বরং অতি দ্রুত এ বদ অভ্যাস ত্যাগ করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালাতে হবে। আর নামায আদায়ের পূর্বে এবং মসজিদে প্রবেশের আগে ভালো করে মেসওয়াক বা ব্রাশ করে দুর্গন্ধ দূর করে নিতে হবে।
-(ফাতাওয়াল লাজনাতিদ দাইমা ১৩/৫৬;
আলফাতাওয়াশ শারইয়্যাহ ১০/১৪৫;
রদ্দুল মুহতার ১/৬৬১)
ধূমপানের অপকারিতা – পরোক্ষ ধূমপানের ক্ষতিকর প্রভাব
গবেষণায় দেখা গেছে সিগারেটের ধূমপানে নিকোটিনসহ ৫৬টি বিষাক্ত রাসায়নিক পদার্থ বিরাজমান। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার উদ্যোগে বিশ্বের ১৯২টি দেশে পরিচালিত একটি গবেষণা প্রতিবেদনে জানানো হয়,
নিজে ধূমপান না করলেও অন্যের ধূমপানের
(পরোক্ষ ধূমপান)
প্রভাবে বিশ্বব্যাপী প্রতিবছর প্রায় ৬,০০,০০০ মানুষ মারা যায়। এর মধ্যে ১,৬৫,০০০-ই হলো শিশু। গবেষণায়ও এও বেরিয়ে এসেছে যে,
পরোক্ষ ধূমপান পুরুষের তুলনায় নারীর উপর বেশি ক্ষতিকর প্রভাব ফেলে। পরোক্ষ ধূমপানের কারণে বিশ্বে প্রতিবছর প্রায় ৮১,০০০ নারী মৃত্যুবরণ করেন। এর আগে ২০০৪ খ্রিস্টাব্দে পরিচালিত এজাতীয় আরেকটি গবেষণায় দেখা গিয়েছিলো যে,
পরোক্ষ ধূমপানের শিকার হওয়া ব্যক্তিদের ৪০%
শিশু,
৩৩%
অধূমপায়ী পুরুষ এবং ৩৫%
অধূমপায়ী নারী রয়েছেন। তাতে এও ফুটে ওঠে যে,
পরোক্ষ ধূমপানের কারণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির স্বীকার হচ্ছেন ইউরোপ ও এশিয়ার মানুষ।
গ্লোবাল এডাল্ট টোবাকো সার্ভে অনুসারে,
বাংলাদেশে ৪ কোটি ১৩ লাখ লোক পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার। এর মধ্যে ১ কোটি নারী। কর্মক্ষেত্রে ৬৩%,
পাবলিক প্লেসে ৪৫%
মানুষ ধুমপান করছে। আরও জানা যায়,
শুধুমাত্র দেশের সকল রেস্তোরাঁ ও হোটেলে ২ কোটি ৫৮ লাখ মানুষ ধূমপান করছে। চিকিৎসকরা বলেছেন-
ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য সেবনের ফলে ২৫টি প্রাণঘাতী রোগের প্রধান কারণ চিহ্নিত করা হয়েছে। তামাক বলতে শুধু বিড়ি বা সিগারেট সেবনকে বুঝায় না। পানের সাথে জর্দ্দা,
সাদা,
গুল,
খৈন,
নার্সি ইত্যাদিকেও বুঝায়। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ভাষায়-
বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম ধূমপায়ী চিহ্নিত দেশ
শিশুর জন্য সমস্যা
পরোক্ষ ধূমপানের জন্য শিশুরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতির শিকার হয়। শিশুরা সাধারণত নিন্মলিখিত স্বাস্থ-ঝুঁকিতে পড়েঃ
– ফুসফুসে নানা ধরনের সংক্রমণ;
– ব্রঙ্কাইটিস ও নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা;
– শিশুর কানে সংক্রমণ;
– শিশু শ্বাসকষ্টে ভোগা
– দীর্ঘদিন কাশি;
– অ্যাজমা
– গলাব্যথা,
নাক দিয়ে পানি ঝরা।
– রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা কমিয়ে ফেলা
এমনকি শিশু
Sudden infant death syndrome (SIDS) এর শিকারও হতে পারে এই পরোক্ষ ধূমপানে।
নারীর জন্য সমস্যাঃ নারীর উপরও পরোক্ষ ধূমপানের প্রভাব অত্যন্ত উদবেগজনক। বিশেষকরে গর্ভবতী নারীর খুবই ঝুঁকিতে থাকে এর প্রভাবে। গর্ভবতী নারীর ক্ষেত্রে পরোক্ষ ধুমপানে যা ঘটতে পারেঃ
– মিসকেরেজ
(miscarriage)
– stillbirth
– জন্মকালীন শিশুর স্বল্প ওজন
বাংলাদেশ থেকে মাদক সম্পূর্ণ নির্মূল করতে হলে তামাক নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী
‘সাউথ এশিয়ান স্পিকার সামিট’-এ ২০৪০ সালের মধ্যে
‘তামাকমুক্ত বাংলাদেশ’ গড়ার ঘোষণা দিয়েছেন। এ লক্ষ্যে মাদক নির্মূলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত তাদের চলমান কার্যক্রমের সঙ্গে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীন
‘জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ সেল’র সঙ্গে ২০১৩ সালে সংশোধিত
‘ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার নিয়ন্ত্রণ আইন’ বাস্তবায়নে সমন্বিতভাবে কাজ করা। এর সঙ্গে যে নীতিগুলোর প্রণয়ন চলমান রয়েছে
(জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ কর্মসূচি,
রোডম্যাপ,
তামাক চাষ নীতিমালা ইত্যাদি),
অনতিবিলম্বে সেগুলো চূড়ান্ত করা অত্যন্ত জরুরি। নিঃসন্দেহে দীর্ঘমেয়াদে এর সুফল পাওয়া যাবে। একইসঙ্গে বিদ্যমান আইন ও নীতিগুলো কিভাবে বাস্তবায়ন করা যায় সেদিকে নজর দেওয়া প্রয়োজন। এখানে শুধু স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় নয়,
সব মন্ত্রণালয়,
দপ্তর,
বিভাগের সমন্বয় জরুরি।
অধ্যাপক ড.
অরূপরতন চৌধুরী
: প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি,
মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা
(মানস);
সদস্য,
জাতীয় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ বোর্ড
(স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়)
এবং জাতীয় তামাক নিয়ন্ত্রণ টাস্কফোর্স কমিটি
(স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়)
অর্ডিনারি আইটির নীতিমালা মেনে কমেন্ট করুন। প্রতিটি কমেন্ট রিভিউ করা হয়।
comment url